IOI ২০১৪ - ঢাকা টু তাইপেই ভায়া কুনমিং

হাসনাইন হেইকেল জামি | জুলাই ১১, ২০১৪
আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড ২০১৪ তে বাংলাদেশ দলের সাথে তাইওয়ান গেছেন দলনেতা হাসনাইন হেইকেল জামি। তার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিদিন Progক্রিয়া তে লিখবেন তিনি।

IOI 2014

IOI ২০১৪ এর ব্যানার এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে তাইওয়ানের বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক - তাইপেই ১০১ ফটো কার্টেসি - IOI 2014 ফেসবুক পেইজ।



ঢাকা এয়ারপোর্ট ছেড়েছি, মনে হচ্ছে সেটা অনেক আগের ঘটনা। এর মধ্যেই এত কিছু ঘটে গেছে, ঘটনাটা যে মাত্র ২৪ ঘন্টা আগের ব্যাপার বিশ্বাস হতে চায় না। এর মধ্যেই আমরা দুইটি দেশ পার করে চলে এসেছি তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেই শহরে। অপেক্ষা করছি বিশ্বের অন্যতম সেরা মেধার প্রতিযোগিতা ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড অফ ইনফরমেটিক্সে অংশ নেওয়ার জন্য।

ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডের সাথে গত তিন বছর ধরে কাজ করলেও, টিমের সাথে এইবারই প্রথম আমার আসা। তাও আবার দলনেতা হিসাবে। মনে করেছিলাম অনেক দায়িত্ব থাকবে হয়ত। কিন্তু কায়কোবাদ স্যার সাথে থাকলে আসলে এইসব কোন চিন্তা করারই দরকার হয় না। বিদেশের এয়ারপোর্ট দেখলেই যেখানে অনেক মানুষের মনে ভয় কাজ করে সেখানে স্যারকে দেখে মনে হল এইটাই বুঝি উনার ঘর-বাড়ি। মোটামুটি নির্বিঘ্নেই আমরা তাইপেই এসে পৌছেছি। এখন তাইপেই শহরের এয়ারপোর্টে বসেই এই লেখা লিখছি।

তাইওয়ানের কোন দূতাবাস আমাদের বাংলাদেশে নেই। কাজেই এইবার আমরা আসলে এসেছি ল্যান্ডিং বা অন-এরাইভাল ভিসার উপর ভরসা করে। এ ব্যাপারে আই ও আই কমিটি আমাদেরকে অকল্পনীয় সাহায্য করেছে। কাজেই আমরা মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিলাম যে আমাদের ভিসার ব্যাপারে কোন সমস্যা হবে না। যাত্রা শুরুর দিন কায়কোবাদ স্যার বললেন, “একবার ঢাকা ছাড়তে পারলে আর কোন সমস্যা হবে না”। তখন অবাক হলেও পরে দেখলাম, স্যারের কথাই সত্যি। আমাদের কাছে ভিসা নেই, এই ব্যাপারটাতে বাইরে কোন এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন যত না ঝামেলা করল, তার থেকে বেশি ঝামেলা করল আমাদের নিজের দেশের এয়ারপোর্ট। অবশ্য একটু পরেই আবিষ্কার হল যে ইমিগ্রেশনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তার ভাগ্নে স্যারের ছাত্র। এরপর কি আর কোন ঝামেলা থাকে!

এইবারের টিমের তন্ময় মল্লিকের এইটাই প্রথম বিমান ভ্রমন। সুযোগ পেয়ে সবাই তাকে নিয়ে মজা করতে ছাড়ে নি। যেমন এয়ারপোর্টে এসে জানা গেল সে তার কলেজের (নটরডেম) আইডি কার্ড এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ফেলে দিয়েছে(!)। সাথে সাথেই সবাই মিলে বলা শুরু যে ওর তো তাহলে ওর আর যাওয়া হল না আই ও আইতে। ও বরং বাসায় চলে যাক।

এরকম আরো হাজারও খুনসুটি করতে টিমের প্লেনে চেপে বসা। আর একটু পরেই চলে এল সেই মোক্ষম মূহুর্ত যার জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল, খাবার! কিন্তু খাবার প্যাকেট খুলে সবাই মহা মুশকিলে পড়ে গেল। কোন খাবার যে কি তা বুঝে ওঠাই দায়। খালি ভাত, মুরগি আর কিছু সবজি চিনতে পারা গেল। কিন্তু বাকিগুলা চেনাই দুস্কর। ঢাকা থেকে কুনমিং, কুনমিং থেকে তাইপেই দুই প্লেন যাত্রাতেই আমাদের অবস্থা প্রায় একই রকম। খাবার চিনি না। চিনলেও খেয়ে তাতে কোন স্বাদ পাওয়া যায় না। প্রায় কালো রঙের একটা ডিম দেখা গেল। সেটা কি অতি সম্প্রতি ছড়ানো ফেসবুকের চাইনিজ নকল ডিম কিনা, তা নিয়েও গবেষনা চলল বেশি কিছুক্ষন। শেষ পর্যন্ত জুস খেয়েই আমরা প্লেন যাত্রায় বেঁচে থাকলাম।

কুনমিং এ রাত কাটিয়ে আমরা তাইপেই এসেছি। রাত কাটানোর সে অভিজ্ঞতাও বেশি মজার। যে হোটেলে আমরা ছিলাম, সেটি হোটেল হিসাবে বেশ ভাল হলেও তার আশেপাশের এলাকাকে হয়ত শহরতলী বা গ্রামই বলা যায়। হোটেলের লোকজন খুব একটা ইংরেজী না পারায় আমাদের জীবন বেশি দুর্বিষহ হয়ে উঠল। রাতের খাবারের জন্য ডলার ভাঙ্গিয়ে চাইনিজ ইউয়ান কেনার জায়গা প্রায় আধঘন্টা জিজ্ঞেস করেও বের করতে পারলাম না। পরে আমেরিকাবাসী এক চাইনিজ ভদ্রলোক আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসলেন। যখন জানা গেল আশেপাশে কোন মানি এক্সচেঞ্জ নেই, তখন তিনি ৫০ ইউয়ান উপহারস্বরূপ আমাদের দিলেন। এই লেখার মাধ্যমে উনাকে আরো একবার ধন্যবাদ জানাই।

তবে সেই ইউয়ান নিয়েও আসলে খুব আশা আমরা পাচ্ছিলাম না। খাবার দাবার দেখে কোনটাই আমাদের পছন্দ হয় না। পরে বৃষ্টির পরামর্শে আমরা ইন্সট্যান্ট নুডুলস এর প্যাকট আর গ্রিলড চিকেন কিনে নিলাম। এর সাথে দেশ থেকে আরো কিছু খাবার দিয়ে আমরা ডিনার সারলাম।

কুনমিং এর সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছিল অবশ্য এর আগেই। এয়ারপোর্ট এ নেমেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিবার পরিজনকে খবর পৌছানোর জন্য। কিন্তু এ কি মহা বিপত্তি! না ফেসবুক কাজ করে, না গুগোল। সবার তো মাথায় হাত। এ দুটো ছাড়া আবার আমাদের জীবন চলে নাকি? কিন্তু চাইনিজ সরকার এ দুটোই বন্ধ করে রাখায় মোটামুটি সবারই ফ্রি ওয়াই-ফাই পাওয়ার আনন্দ মাটি হয়ে গেল। অবশ্য এর মধ্যেও নেটের ভাল স্পিড দেখে হাছিব আর তন্ময় টরেন্টের মাধ্যমে ডাউনলোডে ব্যস্ত হয়ে গেল। ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে কি না!

কুনমিং এর আরো একটা মজার ব্যাপার ছিল আমাদের হোটেলের বাথরুমে। রুমে ঢোকার কিছুক্ষন পর লাবিব এসে আমদেরকে বলল যে বাথরুমের দেয়াল কাচের এবং সেটার ভিতর দিয়ে বাথরুমের সবই দেখা যাচ্ছে! আমাদের তিন রুমের মধ্যে শুধু একটা রুমেই পাওয়া গেল নিরেট দেওয়ালের বাথরুম। পরে সেটাকেই সবাই ব্যবহার করতে বাধ্য হল।

কুনমিং থেকে কাক ডাকা ভোরে রওনা হয়ে আমরা তাইপেই পৌছে গেলাম দুপুরের আগেই। নির্বিঘ্নেই ভিসার কাজ শেষ করে ইমিগ্রেশন পার করে, ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে পেট ভর খেয়ে এখন বসে আছি তাইপেই এয়ারপোর্টে। কায়কোবাদ স্যার সেলফি তুলছেন। হাছিব মরা লাশের মত ঘুমাচ্ছে। বৃষ্টি ঘ্যান ঘ্যান করছে আর লাবিব বসে বসে ঘ্যান ঘ্যান শুনছে। আবার পরে লেখা হবে। আপাতত এইখানেই বিদায়।


হাসনাইন হেইকেল জামি

হাসনাইন হেইকেল জামি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং একাধিক ন্যাশনাল প্রোগ্রামিং কন্টেস্টের চ্যাম্পিয়ন। বাংলাদেশ ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামিং টিমের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।